ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা ই-কমার্স—আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। দেশে দ্রুত বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, তবে সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না নিরাপত্তা সচেতনতা। অনেক ব্যবহারকারীই জানেন না কীভাবে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করতে হয়, কেন সফটওয়্যার আপডেট রাখা জরুরি, কিংবা কীভাবে ফিশিং ইমেইল শনাক্ত করা যায়। এর ফলেই সহজে চুরি হচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য, হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট ও আর্থিক লেনদেন। ঠিক এ কারণেই সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস উদযাপন আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাপী অক্টোবর মাসকে পালন করা হয় সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতার মাস হিসেবে। এর লক্ষ্য হলো সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব তুলে ধরা, ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমে কীভাবে ডিজিটাল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যায় তা শেখানো, এবং ডিজিটাল প্রতারণা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায় সম্পর্কে সবাইকে জানানো। এ বছরের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতার মাসের প্রতিপাদ্য, ‘সাইবার সচেতন হোন, নিরাপদ থাকুন’।

মাসব্যাপী এ কর্মসূচিকে চারটি সপ্তাহে ভাগ করা হয়েছে। সাইবার জগতের নিরাপত্তার নানা বিষয় তুলে ধরতে চার সপ্তাহের জন্য রয়েছে চারটি আলাদা থিম: প্রথম সপ্তাহে পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা, দ্বিতীয়টিতে মাল্টিফ্যাক্টর অথেনটিকেশন, তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহের থিম হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে যথাক্রমে নিয়মিত সফটওয়্যার হালনাগাদ ও সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক না করার বিষয়ে প্রচারণা ।

পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা বিষয় বললেই প্রথমে চলে আসে আপনার অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলোর পাসওয়ার্ড আপনি কীভাবে সেট করেছেন। পাশাপাশি তা কোথায় সংরক্ষণ করছেন এবং সেগুলো আপনি কারো সঙ্গে শেয়ার করেছেন কি না। একটি অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার প্রথম শর্ত হলো শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড বলতে ছোট অক্ষর, বড় অক্ষর, নাম্বার ও বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন মিলিয়ে গড়া অনন্য একটি পাসওয়ার্ড যা কেউ সহজে অনুমান করতে পারবে না। প্রত্যেক অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা খুব জরুরি। একাধিক পাসওয়ার্ডের জন্য একই প্যাটার্ন, ব্যক্তিগত কোনো তথ্য যেমন- প্রিয় নাম, জন্ম তারিখ ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু একাধিক অ্যাকাউন্টের অসংখ্য পাসওয়ার্ড মনে রাখাও কষ্টসাধ্য। এর জন্য ব্যবহার করতে পারেন ওপেন সোর্স পাসওয়ার্ড ম্যানেজার, যার নিরাপত্তা আপনি যাচাই করতে পারবেন। আমরা এইরকম কয়েকটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার এর নাম পরামর্শ দিয়ে থাকি। যেমন- বিটওয়ার্ডেন, প্রোটন পাস, লাস্টপাসকি ইত্যাদি। এতে আপনার শুধু পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মাস্টার পাসওয়ার্ডটি মনে রাখার প্রয়োজন হয়। এখানে আপনি আপনার সকল অ্যাকাউন্ট এর পাসওয়ার্ড সেইভ করে রাখতে পারবেন এবং এই তথ্য স্বয়ং সেই কোম্পানিও দেখতে পারে না। ফলে কোনো ডায়রি বা ফাইলে লিখে রাখার বদলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে লিখে রাখা নিরাপদ। আপনার পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত থাকলে আপনি অনলাইন জগতে নিরাপদভাবে কাজ করতে পারবেন।

পাসওয়ার্ডের সঠিক ব্যবস্থাপনার পর ডিজিটাল নিরাপত্তায় আরেকটি স্তর যোগ করা জরুরি: টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (টুএফএ)। এর কাজ আপনার অনলাইন অ্যাকাউন্টকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া। ধরুন, আপনার ফেসবুক পাসওয়ার্ড কেউ জেনে গেল এবং যে আপনার অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করতে চাইল। এক্ষেত্রে টুএফএ সচল থাকলে সে অ্যাকাউন্টে এক্সেস করতে গেলেই ফেসবুক আপনাকে একটি নোটিফিকেশন পাঠাবে এবং যাচাই করতে বলবে লগইন করতে চাওয়া ব্যক্তি আপনি কি না। ফলে আপনার অ্যাকাউন্ট হ্যাক থেকে বেঁচে যাবে। সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই এখন এই সুবিধা রয়েছে। তাই অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে এটি চালু রাখা অবশ্য কর্তব্য।

ডিজিটাল জগতে সুরক্ষিত থাকার আরেক উপায় হলো নিয়মিত সফটওয়্যার হালনাগাদ করা। আমাদের ব্যবহৃত সকল ধরনের ডিভাইসের প্রাণ হচ্ছে এর অপারেটিং সিস্টেম। পাশাপাশি আমাদের কাজকর্ম করতে হয় নানা ধরনের সফটওয়্যার দিয়ে। সুতরাং, এসব সফটওয়্যার ত্রুটিপূর্ণ রয়ে গেলে এবং এর মধ্যে দুর্বলতা থেকে গেলে তা ডিভাইসের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে। এর থেকে মুক্তি পেতে আমাদের প্রয়োজন নিয়মিত এই সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম আপডেট রাখা। অনেকে মনে করেন সিস্টেম আপডেট করলে ডিভাইসের ক্ষতি হতে পারে। তাদের এ ধারণা ভুল। সিস্টেম আপডেট না করলেই বরং ডিভাইস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সফটওয়্যার তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত এর দুর্বলতাগুলো শনাক্ত করে পরবর্তী আপডেটে এসব সমস্যামুক্ত ভার্সন বাজারে আনেন। তাই নিয়মিত সফটওয়্যার হালনাগাদ করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হওয়া উচিত এসব সফটওয়্যার ও অ্যাপ ডাউনলোড করার সময় এদের এগ্রিমেন্ট ও পলিসিগুলোও যাচাই করা উচিত যাতে আপনার কোন কোন তথ্য ব্যবহারের অ্যাক্সেস চাচ্ছে সে সম্পর্কে অবহিত হয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফিশিং থেকে কীভাবে আপনি রক্ষা পাবেন এই অনলাইন জগতে। বর্তমানে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে ফিশিং অ্যাটাক। ডিজিটাল পরিসরে কৌশলে কোনো ব্যক্তির সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ অথবা চুরি করার নামই ফিশিং। এর কারণে ব্যক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ছাড়াও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। সম্প্রতি ফিশিংয়ে দেখা যাচ্ছে নিত্যনতুন কৌশলের ব্যবহার। যেমন, বিশেষ কোনো উৎসবের সময় স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম করে মানুষের কাছে পাঠানো হচ্ছে ফিশিং লিংক। কখনো পণ্যে ছাড়, আবার কখনো উৎসব উপলক্ষে গিফটকার্ড আবার কখনো কোনো ব্যাংকের নাম নিয়ে ব্যক্তির কার্ড, অ্যাকাউন্ট নাম্বার ইত্যাদি সংগ্রহ করছে প্রতারকরা। এতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও ডিভাইসে ভাইরাস, ওয়ার্ম, অ্যাডওয়্যার, বা রান্সমওয়্যার ইত্যাদি ক্ষতিকর ম্যালওয়ার ইন্সটল করে নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছেন ব্যবহারকারীরা। ফলে যেকোনো লিংকে ক্লিক করার আগে অবশ্যই চেক করা প্রয়োজন। লিংকটি ‘HTTP’ না ‘HTTPS’ দিয়ে শুরু, এটি কার কাছ থেকে এসেছে তা চেক করা, বানান ও লোগো সঠিক কি না, কোনো অ্যাটাচমেন্ট ডাউনলোড করতে বলছে কি না, ব্যক্তিগত তথ্য বা লগইন ডেটা চাচ্ছে কি না এরূপ নানা ধরনের যাচাই করতে হবে। এছাড়াও আপনি লিংক চেক করতে ব্যবহার করতে পারেন ‘ভাইরাস টোটাল’ (Virus Total) নামের একটি সফটওয়্যার যা আপনার দেওয়া লিংকটি সঠিক কি না তা যাচাই করে দিবে বিভিন্ন নিরাপত্তা দিক বিবেচনা করে। সুতরাং, সন্দেহজনক কোনো মেইল বা লিংক মনে হলেই তা বাদ দিতে হবে, ক্লিক করা যাবেনা।

পরিশেষে, অনলাইন জগতে নিরাপদ থাকা ও সুরক্ষিত ভাবে কাজ করা আমাদের সকলের কাম্য। ফলে, আমাদের প্রয়োজন নিয়মিত এই সকল অভ্যাস গড়ে তোলা যা আমাদের এবং আশেপাশের মানুষকে বিভিন্ন হুমকি ও ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে এবং সুরক্ষিত থাকতে সহায়তা করবে। অনলাইনে নিজেও নিরাপদ থাকুন ও অন্যকেও নিরাপদ থাকতে সাহায্য করুন।

 

 

A free in-person training is happening every month!