আমরা প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরণের বিষয়বস্তু পোস্ট করে থাকি। অনলাইনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা, টাকা লেনদেন, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগ অতি সহজে আমরা প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছি। এসব কাজে আমাদের ব্যবহার করা সকল তথ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমাদের এক্টিভিটি হিসেবে জমা থাকে। এটিকে ডিজিটাল পদচিহ্ন বা ডিজিটাল ছায়া বলা হয়ে থাকে। মানে আপনি অনলাইনে যা কিছু করেন, যেমন – কোন সাইট ভিজিট করেন, কি মেইল পাঠান, কি তথ্য দেন – সব কোথাও না কোথাও আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট আকারে জমা হয়। এটা দিয়ে আপনার অনলাইন এক্টিভিটি ট্র্যাক করা সম্ভব। আপনি জানতে বা না জানতেই এই ফুটপ্রিন্ট তৈরি হতে থাকে!
আপনি ফেসবুক, ইমো বা হোয়াটসঅ্যাপে যা কিছু করেন, শপিং সাইটে যা কিনেন, বা কোনো ওয়েবসাইটে মন্তব্য করেন – এসবই আপনার ‘ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট’ বা ইন্টারনেট ছাপ বাড়ায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেক সময় আপনি টেরও পান না যে আপনার এই ছাপ পড়ছে!
যেমন:
- আপনি কোনো সাইটে ঢুকলেই সেটি আপনার ফোন/কম্পিউটারে ছোট ছোট ‘কুকিস’ জমা রাখে।
- মোবাইল অ্যাপগুলো আপনাকে না জানিয়ে আপনার তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে।
- কোনো অ্যাপ বা সাইটকে অনুমতি দিলে, তারা আপনার তথ্য অন্যকে দিতে পারে।
- সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কোনো হ্যাকিং হলে আপনার গোপন তথ্য (পাসওয়ার্ড, ফোন নম্বর ইত্যাদি) চলে যেতে পারে।
এজন্যই ইন্টারনেট ব্যবহারে একটু সতর্ক থাকা জরুরি। ছোটখাটো সাবধানতা আপনাকে বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে।
ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট দুই ধরনের হয়ে থাকে-
সক্রিয় ফুটপ্রিন্ট (যা আপনি নিজে শেয়ার করেন):
- সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, কমেন্ট বা লাইক দেওয়া
- অনলাইন ফর্ম পূরণ করা (যেমন রেজিস্ট্রেশন বা সার্ভে)
- কোনো ওয়েবসাইটে লগ ইন করা
এগুলো আপনি সচেতনভাবে করেন, তাই একে সক্রিয় ফুটপ্রিন্ট বলে।
প্যাসিভ ফুটপ্রিন্ট (যা আপনার অজান্তে রেকর্ড হয়):
- ওয়েবসাইট আপনার ব্রাউজিং হিস্ট্রি ট্র্যাক করে
- অ্যাপগুলো আপনার লোকেশন বা ডিভাইস তথ্য সংগ্রহ করে
- বিজ্ঞাপনদাতারা আপনার আগ্রহ বুঝে টার্গেটেড বিজ্ঞাপণ দেখায়
এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়, আপনি টেরও পান না!
ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট এর গুরুত্বঃ
আপনি ইন্টারনেটে যা কিছু করেন – ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া, গুগলে সার্চ করা, অনলাইনে কেনাকাটা করা, এমনকি কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করাও – সবকিছুই আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট তৈরি করে। এই ডিজিটাল ছাপের ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই আছে:
ভালো দিকগুলো:
- আপনার পছন্দমতো ভিডিও, খবর বা বিজ্ঞাপন দেখায় (যেমন YouTube বা Facebook)
- চাকরি পাওয়া বা ব্যবসা করার সময় সাহায্য করে
- অনলাইন ব্যাংকিং বা স্বাস্থ্য সেবাকে সহজ করে
- আপনার মতো আগ্রহের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে
খারাপ দিকগুলো:
- একবার দেওয়া তথ্য ফিরিয়ে নেওয়া কঠিন: আপনি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলেন, পরে মুছে দিলেও অন্য কেউ স্ক্রিনশট নিয়ে রেখে দিতে পারে।
- চাকরি বা পড়াশোনায় সমস্যা: অনেক কোম্পানি এখন চাকরি দেবার আগে সোশ্যাল মিডিয়া চেক করে। একটা অপ্রীতিকর পোস্ট চাকরি পেতে বাধা হতে পারে
- হ্যাকিং বা স্ক্যামের শিকার হওয়া: আপনার দেওয়া তথ্য দেখে কেউ আপনার মতো করে ফেক অ্যাকাউন্ট বানাতে পারে।
- ভুল বোঝাবুঝি: একটা মজার পোস্ট বা কমেন্ট অন্যরা ভুলভাবে নিতে পারে, যা বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কীভাবে সতর্ক থাকবেন-
- শেয়ার করার আগে ভাবুন: যেন তার জন্য পরবর্তীতে সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়
- প্রাইভেসি সেটিংস চেক করুন: কে আপনার পোস্ট দেখতে পারবে তা নিয়ন্ত্রণ করুন
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ এড়িয়ে চলুন: অনেক অ্যাপ আপনার তথ্য সংগ্রহ করে
- শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন: একই পাসওয়ার্ড সব জায়গায় ব্যবহার করবেন না
আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট সুরক্ষিত রাখার সহজ উপায়-
আজকাল চাকরিদাতা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আপনার অনলাইন এক্টিভিটি খুঁজে দেখে। তাই আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট (অনলাইনে রাখা সব তথ্য) সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। নিচে কিছু সহজ টিপস দেওয়া হলো:
১. নিজেই নিজে গুগল করুন
- গুগলে আপনার পুরো নাম লিখে সার্চ দিন
- নামের ভিন্ন বানানও চেক করুন
- যদি কোনো নেতিবাচক তথ্য পান, সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে কন্টাক্ট করে মুছে ফেলার অনুরোধ করুন
২. অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুছুন
- কোন সাইটে আপনার ফোন নম্বর/ঠিকানা থাকলে মুছে ফেলুন
- পুরনো অ্যাকাউন্ট (যেমন অপ্রয়োজনীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল) ডিলিট করুন
৩. শেয়ার করার আগে ভাবুন
- কোনো ফর্ম পূরণের সময় ভাবুন “এটা কি সত্যিই দরকার?”
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপে ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না
৪. সোশ্যাল মিডিয়া সেটিংস চেক করুন
- ফেসবুক/ইনস্টাগ্রামের প্রাইভেসি সেটিংস রিভিউ করুন
- শুধু বন্ধুদের জন্য পোস্ট সীমিত রাখুন
- বায়োতে ফোন নম্বর/ইমেল দেবেন না
৫. নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করুন
- শুধু “https://” ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন (এই সম্পর্কিত আমাদের প্রতিবেদন দেখতে পারেন https://digitalsafetyschool.com/difference-between-http-https/)
- পাবলিক WiFi-তে ব্যাংকিং বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবেন না
- VPN ব্যবহার করুন (এই সম্পর্কিত আমাদের প্রতিবেদন দেখতে পারেন https://digitalsafetyschool.com/what-is-vpn/)
৬. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
- কমপক্ষে ১২ অক্ষরের পাসওয়ার্ড দিন (বড় হাতের অক্ষর, সংখ্যা, প্রতীক মিলিয়ে)
- প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড দিন
- পাসওয়ার্ড ম্যানেজার (যেমন Bitwarden) ব্যবহার করুন
৭. নিয়মিত চেক করুন
- মেডিকেল রেকর্ড রিভিউ করুন
- সফটওয়্যার আপডেট রাখুন
- মোবাইলে পাসকোড দিন
- কোনো লঙ্ঘন হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন
এই সহজ উপায়গুলো মেনে চললে আপনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট নিরাপদ থাকবে এবং ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।