মোবাইলে বা অনলাইনে আপনি প্রতিনিয়ত যেসব মেইল, মেসেজ আদানপ্রদান করছেন, কথা বলছেন, সেগুলো অন্য কেউ দেখে বা শুনে ফেলুক– তা নিশ্চয়ই চাইবেন না। ব্যক্তিগত এসব ডেটা সুরক্ষিত রাখার অন্যতম উপায় এনক্রিপশন পদ্ধতির ব্যবহার। এর মাধ্যমে আপনার একটি বার্তা বা মেইল শুধু তিনিই দেখতে পারবেন, যাকে উদ্দেশ্য করে এটি পাঠানো হয়েছে। মাঝখানে কোনো সংস্থা বা হ্যাকার সেখানে আড়ি পাততে পারবে না।
চিন্তা করুন সেই চিঠি পাঠানো যুগের কথা। একটি চিঠি কোথাও পাঠানোর আগে সেটি পোস্টঅফিসে বা ডাকবাক্সে জমা দিতে হতো একটি হলুদ খামের ভেতরে। তারপর ডাকপিয়ন সেই খামের উপরে থাকা ঠিকানা অনুযায়ী সেটি নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতেই পৌঁছে দিত। ফলে প্রাপক ব্যক্তি ছাড়া ওই খামে কি তথ্য আছে সেটা অন্য কেউ জানতে পারত না। ডাকবিভাগের চিঠির ওই হলুদ খামের মতই কাজ করে এনক্রিপশন পদ্ধতি। ডাক পদ্ধতিতে যেমন প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া অন্য কেউ তথ্য সম্পর্কে জানত না, তেমনি এই এনক্রিপশন পদ্ধতিতেও প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া অন্য কেউ তথ্য সম্পর্কে জানতে পারে পারেনা।
অন্যদিকে আপনি যদি চিঠিটি একটি পোস্টকার্ডের মাধ্যমে পাঠান, তাহলে সবাই দেখতে পারবে সেখানে কী লেখা আছে। এনক্রিপশন ছাড়া পাঠানো বার্তা বা ইমেইল অনেকটা এই পোস্টকার্ডের মতো, যেখানে সেটি প্রাপক ছাড়াও আরও অনেকের দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
এনক্রিপশন কী?
সহজ ভাষায় এনক্রিপশন হচ্ছে এক ধরনের ডেটা সুরক্ষা পদ্ধতি যেখানে তথ্যগুলো বদলে দেওয়া হয় গাণিতিক কিছু অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। যেটিকে বলা হয় সাইফার। এভাবে এনক্রিপশনের মাধ্যমে আপনি যখন একটি টেক্সট বা ছবি পাঠান, তখন সেগুলো এমন কিছু প্রতীক ও সংকেতে পরিণত নয়, যা থেকে বার্তাটির মূল অর্থ বোঝার উপায় থাকে না। এনক্রিপ্ট করা এই টেক্সট যখন নির্দিষ্ট প্রাপকের কাছে পৌঁছায়, তখনই কেবল সেটি আবার ফিরে আসে মূল অবস্থায়। যেখানে টেক্সটটি পড়া যাবে বা ছবিটি দেখা যাবে। ফলে এনক্রিপ্ট করা বার্তাটি যদি প্রাপক থেকে প্রেরকের মাঝখানে অন্য কারো হাতে পড়েও যায়, তাহলেও কেউ সেটির অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না।
এনক্রিপশনে একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক কি (একগুচ্ছ টেক্সট যেটি পাঠযোগ্য ডাটাকে অপাঠযোগ্য ডেটা/সাইফারটেক্সটে পরিণত করে) ব্যবহার করা হয়। প্রেরক তথ্য পাঠানোর সময় একটি এনক্রিপশন কি প্রয়োগ করে ডেটা এনক্রিপশনের জন্যে, যেটা তথ্য পাবার পর প্রাপক ব্যবহার করে তথ্য পাঠযোগ্য বা ডিক্রিপ্ট করতে। ফলে, সঠিক কি ছাড়া অন্য কেউই এই তথ্য পড়তে পারেনা।
এনক্রিপশন কি ব্যবহারের ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে, এনক্রিপশন পদ্ধতিকে ২ ভাগে করা যায়। সিমেট্রিক ও এসিমেট্রিক এনক্রিপশন। সিমেট্রিক এনক্রিপশন পদ্ধতিতে প্রেরক ও প্রাপক; দুই পক্ষের কাছেই একটি পাবলিক কি থাকে। তথ্য পাঠানো বা গ্রহণের সময় ব্যবহার করা হয় একই কি। অন্যদিকে এসিমেট্রিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে থাকে দুইটি কি। শুরুতে পাবলিক কি-এর মাধ্যমে ডেটা এনক্রিপ্ট করা হয়। এবং প্রেরকের কাছে পাঠানো হয়। তথ্যটি পড়ার জন্য প্রেরকের কাছে থাকে আরেকটি প্রাইভেট কি। শুধুমাত্র এই কি-টি দিয়েই এনক্রিপ্ট করা ডেটাটির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব।
এনক্রিপশন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান; সবার জন্যই ডেটা এনক্রিপশন গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে ইমেইল-মেসেজ বা মোবাইল-ল্যাপটপে থাকা ডেটা সুরক্ষিত রাখার জন্য যেমন এনক্রিপশনের বিকল্প নেই, তেমনি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনও তাদের সংবেদনশীল ডেটাগুলো নিরাপদ রাখার জন্য আশ্রয় নিতে পারে এনক্রিপশন পদ্ধতির।
যেমন, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে যদি গ্রাহক বা ক্রেতার ব্যক্তিগত তথ্য, আর্থিক বিবরণীর মতো বিষয়ের ডেটা থাকে– তাহলে সেগুলো সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা সেগুলো এনক্রিপ্ট করে রাখার কথা ভাবতে পারে। তাহলে ডেটাগুলো যদি অন্য কারো হাতে চলেও যায়– তাহলেও সেগুলো কেউ পড়তে পারবে না।
ইমেইল এনক্রিপশন
প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য আদান-প্রদানে ইমেইল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কোন আর্থিক তথ্য সম্বলিত ইমেইল আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আবার কোনো ইমেইলে আপনার সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ক তথ্য থাকতে পারে। আপনি আপনার অফিসের কিছু ক্লায়েন্টের গুরুত্বপূর্ণ নথি শেয়ার করতে পারেন। এসব তথ্য আপনার নিজের বা প্রতিষ্ঠানের জন্যে অনেক সংবেদনশীল, তাই এসব তথ্য যাতে হ্যাকাররা চুরি করতে না পারে সেজন্য ইমেইল এনক্রিপশন ব্যবহার করা উচিত।
এনক্রিপশন আপনার ইমেইলের সকল তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ইমেইলের সংবেদনশীল তথ্যগুলো ব্যক্তিগত রাখে, ফলে অন্য কেউ সেই তথ্যগুলো চুরি করতে বা পরিবর্তন করতে পারেনা।
এনক্রিপশন নির্ভর ইমেইলের জন্য ব্যবহার করতে পারেন ফোটনমেইল বা টুটানুটার মতো মেইল সার্ভিস। এগুলোতে শুরু থেকেই এনক্রিপশন ব্যবস্থা চালু থাকে। ইয়াহু বা জিমেইল থেকে পাঠানো মেইলগুলোও আপনি এনক্রিপ্ট করে নিতে পারেন। তবে এজন্য ব্যবহার করতে হবে মেইলভেলপের মতো সেবা।
মেসেজ এনক্রিপশন
আপনি যদি চান যে, আপনার পাঠানো ব্যক্তিগত বার্তা বা ফোনকল অন্য কেউ দেখে বা শুনে না ফেলে, তাহলে অবশ্যই এমন কোনো সেবা ব্যবহার করা উচিৎ, যেখানে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন পদ্ধতি চালু আছে। এই ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করে যে, প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া অন্য কেউ বার্তাগুলো পড়তে পারবে না। অনলাইনে নজরদারির ঝুঁকিতে আছেন– এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য এই এনক্রিপশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।
এনক্রিপ্টেড মেসেজ ও ফোনকলের জন্য ব্যবহার করতে পারেন সিগন্যাল বা টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ। জনপ্রিয় ম্যাসেঞ্জিং অ্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপেও আছে এই এনক্রিপশন সুবিধা।
ফাইল এনক্রিপশন
শুধু ইমেইল, কল বা মেসেজের ক্ষেত্রেই নয়, এনক্রিপশন জরুরি ডেটা সুরক্ষার জন্যও। প্রায়ই আমাদের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে জমা থাকে ব্যক্তিগত বা পেশাগত নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেগুলো অন্য কারো হাতে পড়লে আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তেমনটি যেন কোনোভাবেই না হয়– তা নিশ্চিত করতে পারেন ফাইল এনক্রিপশনের মাধ্যমে। ডিভাইসে ফাইল এনক্রিপশনের জন্য ব্যবহার করতে পারেন বিটলকার, ভেরাক্রিপ্ট, বা ফাইলভল্টের মতো সার্ভিস।
বর্তমানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনেক তথ্য সংরক্ষিত থাকে ক্লাউডে। ফলে এখানেও আপনার ডেটা যেন সুরক্ষিত থাকে– সেজন্য এনক্রিপ্টেড ক্লাউড স্টোরেজ সার্ভিস ব্যবহারের কথা বিবেচনা করুন। এজন্য দেখুন সিঙ্ক ডট কম, পিক্লাউড, বা আইড্রাইভের মতো ক্লাউড সার্ভিস।
সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ক্লাউড সার্ভিস, গুগল ড্রাইভও ব্যবহার করে এনক্রিপশন সার্ভিস। তবে আপনি যদি ডেটাগুলো আরও সুরক্ষিতভাবে সেখানে আপলোড করতে চান, তাহলে ব্যবহার করুন বক্সক্রিপ্টর বা ক্রিপ্টোমোটরের মতো এনক্রিপশন সার্ভিস। এগুলোতে ফাইল এনক্রিপ্ট করে যদি গুগল ড্রাইভে সংরক্ষণ করেন, তাহলে অন্য কারো পক্ষেই সেই ডেটায় হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হবে না।
ইন্টারনেটের এই যুগে ব্যক্তিগত যোগাযোগের নিরাপত্তা আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ব্যক্তিগতই নয়, বিশ্বায়নের এই সময়ে প্রযুক্তিগত কারণে বিভিন্ন ব্যবসাও এখন ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল। ফলে, ইন্টারনেট ছাড়া পৃথিবী অকল্পনীয়। কিন্তু এই ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্কতার বিকল্প নেই। খুব সহজেই হ্যাকাররা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে আপনার আর্থিক বা ব্যক্তিগত ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই, আপনার ব্যক্তিগত এসব তথ্য সুরক্ষিত রাখতে এখনই কোন এনক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনার সকল রকম তথ্য নিরাপদ রাখুন। তাহলেই অপরিহার্য কিন্তু বিপজ্জনক এই অনলাইন বিশ্বে আপনি আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি না হওয়া থেকে কম চিন্তিত থাকবেন।