নানা ধরনের ডিজিটাল ঝুঁকি ও হুমকি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যে সকল কাজ নিয়মিত অনুশীলন করা প্রয়োজন তা ডিজিটাল হাইজিন, বা সাইবার হাইজিন নামে পরিচিত। হাইজিন শব্দটি একটু বিভ্রান্তিকর কারণ আমরা শব্দটির অর্থ হিসেবে সাধারণত শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকেই বুঝে থাকি। তবে ডিজিটাল হাইজিন বলতে এখানে আপনার ডিভাইসগুলোকে শারীরিকভাবে পরিষ্কার করার কথা নয়, বরং এটির সঙ্গে আপনার ডিভাইসগুলোকে (যেমন- ফোন, কম্পিউটার এবং ট্যাবলেট ইত্যাদি) সুসংগঠিত, সর্বশেষ আপডেট ও সুরক্ষা প্যাচগুলোর সঙ্গে আপ টু ডেট রাখা এবং এর পাশাপাশি কিছু করনীয় এবং বর্জনীয় জড়িত।

ডিজিটাল হাইজিনের উদ্দেশ্য হল সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ও ডেটা সুরক্ষিত রাখা। এটি অনুশীলন করা আপনার ঘর বা অফিস পরিষ্কার রাখার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ি ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখতে আপনি নিয়মিত ঘরের মেঝে এবং আসবাবপত্র ধুলাবালি পরিষ্কার করেন; খাবার ঢেকে রাখা, দরজায় তালা লাগানো ইত্যাদি নিয়ম মেনে চলেন। তা না হলে আপনার বাড়ি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে অথবা আপনার ঘর থেকে মূল্যবান সম্পদ চুরি হয়ে যাবে। ঠিক একই ভাবে আপনি যদি সাইবার নিরাপত্তার হুমকির জন্য আপনার ডিভাইসগুলোকে নিয়মিত স্ক্যান না করেন, অব্যবহৃত অ্যাপ ও অ্যাকাউন্টগুলো মুছে না ফেলেন এবং সর্বশেষ আপডেটগুলো ইনস্টল না করেন, তাহলে আপনি দেখবেন যে আপনার ডিভাইস ঠিক মত কাজ করছে না, গতি কমে গেছে। এতে ডিভাইসগুলো সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবে।

এই সকল সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী?

উপরে যেমনটা বলা হয়েছে নিয়মিত কিছু ডিজিটাল হাইজিন অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা বেশিরভাগ ডিজিটাল ঝুঁকি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। নিচে এসব গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন সম্পর্কে আমরা জানব।

শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
ডিজিটাল হাইজিন অনুশীলনের মধ্যে পাসওয়ার্ড একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাসওয়ার্ড আপনার তথ্যের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে। পাসওয়ার্ড ব্যবহারে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে।

  • সবসময় নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি আপনার সমস্ত অ্যাকাউন্টের জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করছেন। একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করতে নানা ধরনের অক্ষর এবং বর্ণের মিশ্রণ ব্যবহার করুন। বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং সাংকেতিক চিহ্ন অন্তর্ভুক্ত করুন।
  • কখনোই একই পাসওয়ার্ড অন্য অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করবেন না। ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। আপনার সমস্ত অনলাইন অ্যাকাউন্টের জন্য একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার অর্থ হল, যদি কোনো হ্যাকার আপনার একাধিক অ্যাকাউন্টগুলোর একটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তবে তারা সেই চুরি করা পাসওয়ার্ডটি আপনার অন্যান্য অ্যাকাউন্টগুলোতে অ্যাক্সেস করতেও ব্যবহার করতে পারে।
  • কমপক্ষে ১৪ অক্ষরের পাসওয়ার্ড ব্যাবহার করুন।
  • পাসওয়ার্ডে সহজে অনুমান করা যায় এমন তথ্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। নাম, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, স্বামী বা স্ত্রীর নাম, পছন্দের রং বা প্রাণীর নাম ব্যবহার করা হলে এগুলো সহজেই অনুমান করে হ্যাকার আপনার অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারে।
  • পাসওয়ার্ড গোপন রাখুন। কম্পিউটারের মধ্যে টেক্সট ফাইলে, কাগজে বা ডায়রিতে লিখে রাখবেন না। পাসওয়ার্ড নিরাপদে সংরক্ষণ করতে একটি ভাল মানের পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন (পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে)।
  • প্রযোজ্য ক্ষেত্রে টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন বা টুএফএ (2FA) ব্যবহার করুন। টেকনিক্যালি, কোনো সিস্টেম বা পরিষেবাতে অ্যাক্সেস পাওয়ার জন্য একাধিক অনুমোদন প্রয়োজন হলে এটি ব্যবহার করা হয়। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত জানব।

সব সফটওয়্যার আপডেট রাখুন
সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে তাদের সফটওয়্যারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নিত্যনতুন ফিচার যুক্ত করতে নতুন ভার্সনের সফটওয়্যার আপডেট প্রকাশ করে। আপনার কম্পিউটার, ফোন বা ট্যাবলেটে যখনি কোন সফটওয়্যারর (অপারেটিং সিস্টেমও এর অন্তর্ভুক্ত) আপডেট নোটিফিকেশন পাবেন, যত দ্রুত সম্ভব সর্বশেষ আপডেট ইনস্টল নিশ্চিত করুন। এই সফটওয়্যার আপডেটে সাধারণত এমন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকে যা আপনার ডিভাইসটিকে সাম্প্রতিক ম্যালওয়্যার থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।

অব্যবহৃত অ্যাপ এবং পুরোনো অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলুন
হতে পারে আপনি একটি অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন কেবল এই অ্যাপ বা গেমসটি কেমন তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য, অথবা আপনি অনলাইনে কেনাকাটা করার জন্য একটি নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে হয়তো ঐ অ্যাপ বা অ্যাকাউন্ট আর ব্যবহার করেন না। এই অব্যবহৃত অ্যাপস এবং অ্যাকাউন্টগুলো সাইবার নিরাপত্তা হুমকির কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যে পুরোনো অ্যাপগুলো আর আপডেট পায় না বা আপনি আপডেট করেন না, তার মানে সেগুলো নতুন অ্যাপের মতো সুরক্ষিত নয়। আপনার তৈরি করা পুরোনো অ্যাকাউন্টগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য যা আপনি আর ব্যবহার করেন না। এই ধরনের অ্যাপ বা অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলুন।

অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন
আপনার ডিভাইসগুলোকে অনলাইন বা অফলাইনের ক্ষতিকর ম্যালওয়্যার থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ইনস্টল করা এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ আবশ্যকীয়। এধরনের সফটওয়্যার আপনার ডিভাইসকে সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ক্রমাগত স্ক্যান করে এবং কোনো সমস্যা খুঁজে পেলে অবহিত করার পাশাপাশি ক্ষতিকর ম্যালওয়্যার/ভাইরাস মুছে ফেলে আপনার তথ্য নিরাপদ রাখে। আর্থিক সক্ষমতা থাকলে একটি ভাল মানের অ্যান্টিভাইরাস লাইসেন্স কিনে ফেলুন বা বিনামূল্যে সংস্করণ ব্যবহার করুন। নিরাপত্তার দিক থেকে উভয়ই প্রায় সমান।

সন্দেহজনক ওয়েবসাইট থেকে কিছু ডাউনলোড করবেন না
যখনই একটি ওয়েবসাইট পরিদর্শন করবেন, তখন আপনি লক্ষ্য করবেন যে ইউআরএলটি (URL) “এইচটিটিপিএস” (https) বা “এইচটিটিপি” (http) দিয়ে শুরু হয়। এখানে “এস” (s) এর অর্থ হল “সিকিউর” (secure), যার অর্থ ওয়েবসাইটটি সুরক্ষিত। আপনি যদি এমন একটি ওয়েবসাইটে লগ-ইন করেন যেটির ইউআরএলের (URL) প্রথম অংশে “এস” (s) নেই, তাহলে আপনার সচেতন হওয়া উচিত এবং ঐ সকল ওয়েবসাইট থেকে কোনো কিছু ডাউনলোড করা বা সেখান রেজিস্ট্রেশন বা লগইন করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

ভিপিএন ব্যবহার করুন
ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন (VPN) আপনার ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপন করে আপনার ইন্টারনেট ব্যবহারকে নিরাপদ করে। এটি সাইবার অপরাধীদের থেকে আপনার ইন্টারনেট কার্যকলাপ গোপন রাখে এবং আপনার ইন্টারনেট ট্রাফিক এনক্রিপ্ট করে আপনার তথ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। (পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে)

ব্যাকআপ রাখুন
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং নানা কারণে আপনার কম্পিউটারে/মোবাইলে সংরক্ষিত তথ্য হারিয়ে যেতে পারে, নষ্ট হতে পারে। যেমন- আগুন লাগতে পারে, মোবাইল বা কম্পিউটার চুরি হতে পারে, ম্যালওয়্যার আক্রান্ত হতে পারে। এমন দুর্ঘটনা থেকে তথ্যের নিরাপত্তা দিতে ব্যাকআপ রাখুন। ব্যাকআপ মূল ডিভাইস থেকে দূরে অন্য কোথাও রাখুন। এমনভাবে রাখুন যেন সেটি শুধু আপনিই এক্সেস করতে পারেন। (পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে)

অচেনা যোগাযোগ থেকে সাবধান থাকুন
অপরিচিত কেউ আপনাকে কোনো ইমেইল বা মেসেজ পাঠালে সেখানে কোনো তথ্য দেওয়ার পূর্বে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে নিন। এছাড়া এসব ইমেইল বা মেসেজ থেকে কোন সংযুক্তি ডাউনলোড করার পূর্বে তা ভাইরাসটোটালডটকম – এ স্ক্যান করে নিন। ডাউনলোড করা ফাইল ওপেন করার আগে অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে স্ক্যান করুন।

অনলাইনে নিজের তথ্য সীমিত রাখুন
আপনি অনলাইনে কোনো তথ্য একবার প্রকাশ করলে সেটি সারা জীবনের জন্য সেখানে থেকে যায়; আপনি মুছে ফেললেও সেটি নানা স্থানে সংরক্ষিত থেকে যায়। তাই নিজের কোনো তথ্য প্রকাশ করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন কে কে সেই তথ্যে প্রবেশ করতে পারবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না। আপনার প্রকাশিত ছোট ছোট ব্যক্তিগত তথ্য আপনার বা আপনার পরিবারকে সাইবার ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

ডিজিটাল হাইজিনকে অগ্রাধিকার দিন। ভালো ডিজিটাল হাইজিন অনুশীলন করার অর্থ হল এটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়া – যেমন আপনার হাত ধোয়া এবং দাঁত ব্রাশ করা। এটি এমন জিনিস নয় যে আপনি একবার করলেন আর কখনোই করলেন না, বরং এমন কিছু যা আপনাকে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তায় শতভাগ নিরাপত্তার কোন অস্তিত্ব নেই। আপনি নানা ধরনের অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে, কিছু টুলস ব্যবহার করার মাধ্যমে অন্যদের চেয়ে আরও বেশি সুরক্ষিত থাকবেন, যা আপনাকে সহজ টার্গেট হওয়া থেকে নিরাপত্তা দেবে।

A free in-person training is happening every month!