বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর যুগে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় প্রতিটি খাতেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের তথ্য এখন মুহূর্তেই হাতের মুঠোয় পাওয়া যাচ্ছে, যা আমাদের জীবনে এনেছে অভাবনীয় গতি ও সুবিধা।
তবে এই সুবিধার পাশাপাশি ইন্টারনেটের উন্মুক্ততায় কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটে সব ধরনের কন্টেন্ট সবার জন্য উন্মুক্ত থাকায় তা অনেক ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোর কিংবা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এই কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট সেন্সরশিপ এবং কন্টেন্ট ফিল্টারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে।
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ হল সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা ইন্টারনেটের কিছু কন্টেন্ট ব্লক বা নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া, যাতে ব্যবহারকারীরা সেইসব ওয়েবসাইট, ভিডিও বা তথ্য দেখতে বা শেয়ার করতে না পারে। সাধারণত ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, ‘সামাজিক শৃঙ্খলা’ বা ‘নৈতিকতা’র নামে এই সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। তবে এটি অনেক সময় ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতাকেও সীমিত করে দেয়।
অন্যদিকে, কন্টেন্ট ফিল্টারিং হল এমন একটি প্রযুক্তি যা নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট, ই-মেইল বা অনলাইন কন্টেন্টে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষতিকর বা অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য ব্লক করে। এটি সাধারণত সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার দুই ধরনের হয়ে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফায়ারওয়ালে এটি ব্যবহার করে কর্মীদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্লক করা বা বিপজ্জনক ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেস রোধ করা। বাড়ির কম্পিউটার ব্যবহারকারীরাও সাইবার নিরাপত্তা বা প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের জন্য কন্টেন্ট ফিল্টারিং ব্যবহার করে থাকে। যদিও এটি নিরাপত্তা বাড়ায়, কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার ইন্টারনেট স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে।
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ যেভাবে কাজ করে
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি সাধারণত অপ্রত্যাশিতভাবে প্রয়োগ করা হয়। যেমন-
- ডিএনএস টেম্পারিং: ডিএনএস টেম্পারিং হল একটি কৌশল যার মাধ্যমে হ্যাকাররা ডিএনএস রেকর্ডে অ্যাক্সেস পেতে পারে। ডিএনএস সার্ভারে একবার অ্যাক্সেস পেলে, তারা সার্ভারের রেকর্ডেড ডেটা পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে। এর ফলে ভাইরাস আক্রমণ বা পরিচয় তথ্য চুরি হতে পারে।
আইপি অ্যাড্রেস ব্লকিং: ইন্টারনেট সেন্সরশিপের একটি সাধারণ পদ্ধতি হল আইপি অ্যাড্রেস ব্লক করা। আইপি অ্যাড্রেস আপনার কম্পিউটারকে বলে যে আপনি ডোমেইন নাম টাইপ করলে আসলে কোথায় যেতে হবে। নির্দিষ্ট আইপি অ্যাড্রেসগুলো অ্যাড-হক ভিত্তিতে বা অঞ্চল ভিত্তিতে ব্লক করা যায়, যাকে সাধারণত জিও-লোকেশন বা জিও-ব্লকিং বলা হয়। - কিওয়ার্ড ফিল্টারিং: প্যারেন্টাল কন্ট্রোলে সাধারণভাবে ব্যবহৃত কিওয়ার্ড ফিল্টারগুলো স্বয়ংক্রিয় বা ম্যানুয়ালি নির্দিষ্ট কিওয়ার্ড ব্লক করে। বৃহৎ পরিসরের সেন্সরশিপেও কিওয়ার্ড ফিল্টারিং ব্যবহার করা হয়, বিশেষত এমন দেশগুলোতে যারা তথ্য দমন করতে চায়।
- প্যাকেট ফিল্টারিং: ডোমেইন নাম বা কিওয়ার্ড দ্বারা ফিল্টার করার পরিবর্তে, কিছু ফায়ারওয়াল তাদের প্রসেসিং করার সিদ্ধান্ত নেয় নিচের বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে:
– প্রোটোকল
– পোর্ট
– নেটওয়ার্ক অ্যাড্রেস
– সোর্স আইপি অ্যাড্রেস
– ডেস্টিনেশন আইপি অ্যাড্রেস
এই ফিল্টারগুলো অ্যান্টিভাইরাস সফ্টওয়্যারের মতো ক্ষতিকারক-ট্র্যাফিক ফিল্টার (যা সাধারণত ফায়ারওয়াল ফিল্টার করে) করার পরিবর্তে, শুধুমাত্র সোর্স এবং ডেস্টিনেশন আইপি অ্যাড্রেসের উপর ভিত্তি করে কাজ করে থাকে। পরিচিত আইপি অ্যাড্রেসগুলিকে অ্যাক্সেস দেওয়া এবং অপরিচিতগুলিকে ব্লক করা হয়।
- ট্র্যাফিক শেপিং: এটি প্যাকেট শেপিং নামেও পরিচিত। ট্র্যাফিক শেপিং হল ব্যান্ডউইথ পরিচালনার একটি উপায় যা কিছু অ্যাপ্লিকেশনকে অন্যদের তুলনায় ভালভাবে কাজ করতে দেয়। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অ্যাপগুলো কোনো সমস্যা ছাড়াই চলবে, কিন্তু যেগুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নয় এমন অ্যাপগুলো থ্রটল বা ধীর হয়ে যাবে। এটি এক ধরনের সেন্সরশিপ হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ এটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভালো পারফর্ম করা অ্যাপ বা পরিষেবা ব্যবহার করতে উত্সাহিত করে, আর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নয় এমন অ্যাপগুলো ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো আইএসপি (ISP) একটি স্ট্রিমিং পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তবে এটি তার ট্র্যাফিককে অগ্রাধিকার দিতে পারে একই সময় তার প্রতিযোগীদের ট্র্যাফিককে থ্রটল করতে পারে।
- পোর্ট নম্বর ব্ল্যাকলিস্টিং: পোর্ট নম্বর ব্ল্যাকলিস্টিং হল যখন একটি আইএসপি (ISP) শুধুমাত্র এর ট্রান্সপোর্ট প্রোটোকল এবং পোর্ট নম্বরের ভিত্তিতে ট্র্যাফিক ব্লক করে দেয় আইপি অ্যাড্রেস উপেক্ষা করে। এটির মাধ্যমে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট নয়, সম্পূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন ব্লক করা যায়।
কন্টেন্ট ফিল্টারের প্রকারভেদ
কন্টেন্ট ফিল্টার বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ব্লক করতে ব্যবহার করা হয়। সাধারণ কন্টেন্ট ফিল্টারের প্রকারগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ইন্টারনেট ফিল্টার: ইন্টারনেট ফিল্টার হল সবচেয়ে সাধারণ মানের কন্টেন্ট ফিল্টার, যা নির্দিষ্ট ওয়েবপেজ বা সম্পূর্ণ ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেস ব্লক করে। এগুলো সাধারণত ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় অথবা ব্রাউজার এক্সটেনশন-ভিত্তিক ফিল্টার হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।
- সার্চ ইঞ্জিন ফিল্টার: সার্চ ইঞ্জিন কন্টেন্ট ফিল্টার ব্যবহারকারীদেরকে এমন সেটিংস সক্রিয় করতে দেয় যা অনুপযুক্ত ফলাফলগুলোকে ফিল্টার করে দেয়। ব্যবহারকারীরা যে কোনো ওয়েবসাইটের ইউআরএল (URL) ব্লক করতে পারে যদি সেখানে প্রাপ্তবয়স্কের জন্য, অশালীন বা অনুপযুক্ত কন্টেন্ট থাকে। কিছু সার্চ ইঞ্জিন শিশু-বান্ধব ফিল্টার্ড ভার্সনও অফার করে, যা শুধুমাত্র শিশুদের জন্য নিরাপদ ওয়েবসাইটগুলো দেখায়।
- ডিএনএস (DNS)-ভিত্তিক কন্টেন্ট ফিল্টারিং: এই ধরনের ফিল্টারিং ডিএনএস (DNS) লেয়ারে কাজ করে এবং কোনো প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সঙ্গে মেলে না এমন ডোমেইনগুলোকে ব্লক করে। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেটিংসেও ডিএনএস (DNS)-ভিত্তিক ফিল্টারিং ব্যবহার করা হয়।
- ইমেইল ফিল্টার: ইমেইল কন্টেন্ট ফিল্টারিং ইমেইলের বডি, হেডার, সাবজেক্ট এবং অ্যাটাচমেন্টে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে। এটি ব্যবহারকারীদের ক্ষতিকর ইমেইল ব্লক করতে, শ্রেণীভুক্ত করতে বা রিজেক্ট করতে সাহায্য করে।
- ওয়েব ফিল্টার: ওয়েব কন্টেন্ট ফিল্টারিং ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট ইউআরএল (URL)-এ অ্যাক্সেস করতে বাধা দেয়, তাদের ব্রাউজারকে কিছু সাইট লোড করতে দেয় না। এছাড়াও, ওয়েব ফিল্টার ওয়েবসাইটের কন্টেন্টের মানের ভিত্তিতে ব্লক করতে পারে, যেমন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাজানো ব্লকলিস্ট ব্যবহার করে।
- প্রক্সি কন্টেন্ট ফিল্টারিং: প্রক্সি ফিল্টার ব্যবহারকারীর ডিভাইস এবং সার্ভারের মধ্যে একটি মধ্যবর্তী হিসাবে কাজ করে। এটি নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী এবং পাবলিক ইন্টারনেটের মধ্যে একটি গেটওয়ে বা মাধ্যমের মতো কাজ করে, যা অ্যাডমিনদেরকে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ফিল্টার, কাস্টমাইজ বা রেস্ট্রিক্ট করতে দেয়। স্কুল-কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অ্যাক্সেস লেভেল দিতে এটি ব্যবহৃত হয়। কিছু সরকারও প্রক্সি ফিল্টারিং ব্যবহার করে নাগরিকদেরকে এমন ওয়েবসাইটে ঢুকতে বাধা দেয় যা তাদের আদর্শ বা দেশীয় নীতির বিরোধী বলে বিবেচিত হয়।
এই ফিল্টারিং পদ্ধতিগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়—কোনোটি নিরাপত্তার জন্য, কোনোটি নিয়ন্ত্রণের জন্য, আবার কোনোটি সেন্সরশিপের হাতিয়ার হিসেবে।
সরকারের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপে ভূমিকা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপ বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ লক্ষ্যে তারা প্রায়ই বিশেষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা মনিটরিং এজেন্সি গঠন করে অনলাইন কন্টেন্ট তদারকি করে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি ও গোপনীয়তা হস্তক্ষেপের ঘটনাও দেখা যায়, যেখানে স্পাইওয়্যার ও অন্যান্য প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিকদের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়।
কখনো কখনো গুজব ও ঘৃণামূলক বক্তব্য রোধের নামে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্লক করা হয়। তবে উদ্বেগের বিষয় হল, অনেক দেশে অনলাইন অপরাধ মোকাবেলার নামে এমন আইন প্রণয়ন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত সরকার বা নেতৃত্বের সমালোচনাকারী সাধারণ নাগরিকদের শাস্তির মুখে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানে জাতীয় প্রতীক, ধর্মীয় অনুভূতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে ইন্টারনেটে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর সমালোচনা করে, এই আইন শান্তিপূর্ণ সমালোচনাকারীদের অপরাধীতে পরিণত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই ধরনের আইন ও নীতিমালা একদিকে যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে প্রণয়ন করা হয়, অন্যদিকে তা নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে সীমিত করে।
ইন্টারনেট সেন্সরশিপে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট সেবাদাতাদের ভূমিকা
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ বাস্তবায়নে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (ISPs) এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যবহারকারীর তৈরি-কন্টেন্ট থাকা প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ নীতির পাশাপাশি দেশের আইন অনুযায়ী কন্টেন্ট মডারেশনের ব্যবস্থা করে থাকে।
- দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কোম্পানিগুলোর উপর কন্টেন্ট ফিল্টারিংয়ের দায়িত্ব বাধ্যতামূলক করেছে। যেমন:
– ইন্দোনেশিয়ার MR5 নিয়ম-এ প্রাইভেট ইলেকট্রনিক সিস্টেম অপারেটরদের কিছু নির্দিষ্ট নিষিদ্ধ কন্টেন্ট ছড়ানো বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
– বাংলাদেশের ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও OTT প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশন-এ অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ‘অবৈধ তথ্য’ প্রকাশে বাধা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। - ফেসবুক, টুইটারের মতো বড় সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোও ভুল তথ্য ও ঘৃণামূলক বক্তব্য রোধে নিজেদের নীতিমালায় কন্টেন্ট মডারেশন যুক্ত করেছে। তাদের কিছু ব্যবস্থা হলো:
– তথ্য যাচাই (Fact-checking)
– সতর্কতা লেবেল যুক্ত করা
– ব্যবহারকারীদের নির্ভরযোগ্য, বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের দিকে নির্দেশ করা
এসব পদক্ষেপ একদিকে যেমন অনলাইন পরিবেশ নিরাপদ রাখতে সাহায্য করে, অন্যদিকে কখনও কখনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিতও করতে পারে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ও কন্টেন্ট ফিল্টারিং: জুলাই ২০২৪ পরিস্থিতি
জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ও কন্টেন্ট ফিল্টারিং কঠোরভাবে বলবৎ রয়েছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনপ্রতিবাদের সময়ে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে লক্ষ্য করা গেছে টার্গেটেড ইন্টারনেট শাটডাউন, সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধকরণ এবং নজরদারি বৃদ্ধি – যা ডিজিটাল অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
জুলাই ২০২৪-এর প্রধান ঘটনাবলী:
১. প্রতিবাদের সময় ইন্টারনেট শাটডাউন
– কর্তৃপক্ষ “জননিরাপত্তা” ও “জাতীয় নিরাপত্তা”-র অজুহাতে আংশিক বা সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধ করেছে।
– প্রতিবাদ সমন্বয়ে বিঘ্ন ঘটাতে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত করা হয়েছে।
২. সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধকরণ
– ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটার (এক্স)-এর মতো প্ল্যাটফর্মে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় বাধা প্রদান।
– ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ)-এর অপব্যবহার করে “রাষ্ট্রবিরোধী” কন্টেন্ট সরাতে টেক কোম্পানিগুলোকে চাপ দেওয়া।
৩. ডিএসএ-এর ব্যাপক ব্যবহার ও নজরদারি
– “অপমানজনক” সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য গ্রেফতার অব্যাহত।
– সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী নেতাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মনিটর করা হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের ইন্টারনেট নীতিতে ডিজিটাল জগতে কঠোর নিয়ন্ত্রণের চিত্র ফুটে উঠেছে, যেখানে সাইবার নিরাপত্তার দাবি এবং নাগরিক অধিকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। কিছু নিয়ন্ত্রণ জরুরি হলেও বাড়াবাড়ি রকমের সেন্সরশিপ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বিপন্ন করছে।
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ যেভাবে এড়ানো যায়
আপনি যদি বাড়িতে, অফিসে, আপনার ISP (ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী) বা আপনার দেশ দ্বারা সেন্সরশিপের শিকার হন, তাহলে অনলাইনে আরও স্বাধীনতা পেতে আপনি বেশ কিছু উপায় ব্যবহার করতে পারেন। কিছু পদ্ধতি বিনামূল্যে, কিছু পদ্ধতি পেইড—তবে সবগুলোই সেট আপ করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় নেবে এবং সেন্সরশিপ থেকে সুরক্ষা বাড়িয়ে দেবে।
- VPN (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক): VPN হল এমন একটি সার্ভিস যার মাধ্যমে আপনি আপনার পরিদর্শন করা ওয়েবসাইট এবং ডিভাইসের IP অ্যাড্রেস এনক্রিপ্ট করতে পারেন। আপনার ইন্টারনেট কার্যকলাপকে একটি নিরাপদ টানেলে লুকিয়ে রেখে, আপনি ওয়েবসাইটের ব্লক বা সীমাবদ্ধতা এড়াতে পারবেন।
- সুরক্ষিত ব্রাউজার: Tor-এর মতো সুরক্ষিত ব্রাউজারগুলো VPN-এর মতোই কাজ করে—আপনার IP অ্যাড্রেস লুকিয়ে রাখে এবং আপনি ট্যাব বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কুকিজ মুছে দেয়। আপনার সমস্ত কার্যকলাপ তিন স্তরে এনক্রিপ্ট করা হয়, যার ফলে আপনি কোনো নিষিদ্ধ ওয়েবসাইট ভিজিট করলেও নিরাপদ থাকবেন।
- ইনকগনিটো মোড ব্যবহার করবেন না: অনেকেই মনে করেন যে ইনকোগনিটো মোড স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের ওয়েব হিস্টোরি মুছে দেয়, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। যদিও স্থানীয়ভাবে (হিস্ট্রি) ডেটা মুছে যায়, কিন্তু আপনার ISP (VPN বা অন্য কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে) এখনও আপনার অনলাইন কার্যকলাপ দেখতে পারে। তাই, ইনকগনিটো মোড শুধু তখনই কার্যকর যখন আপনি আপনার ডিভাইস শেয়ার করা ব্যক্তিদের থেকে আপনার ব্রাউজিং লুকাতে চান—ISP বা সরকারি সেন্সরশিপ থেকে গোপনীয়তার জন্য এটি ভালো বিকল্প নয়।
- প্রক্সি সার্ভার: প্রক্সি সার্ভারগুলো VPN-এর মতোই IP অ্যাড্রেস লুকিয়ে রাখে, যা আপনাকে অনলাইনে আরও স্বাধীনতা দেয়। তবে, VPN-এর মতো সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয় না। VPN আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট করার পাশাপাশি IP লুকায়, কিন্তু প্রক্সি শুধু IP অ্যাড্রেস লুকিয়ে রাখে—ডেটা এনক্রিপ্ট করে না।