একটি সাধারণ পোস্ট, একটি সাধারণ মন্তব্য বা একটি সাধারণ শেয়ার – কীভাবে কারও জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে, তা আমরা প্রায়ই উপলব্ধি করতে পারি না। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত এমন অনেক কিছু ভাইরাল হচ্ছে যা মানুষ শেয়ার করছে । হাসি-তামাশা বা ঠাট্টার মাধ্যমে অনেকে অপমানিত বা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ জাতীয় ঠাট্টাগুলো সাধারনত ডিজিটাল ঠাট্টা হলেও সাইবার প্ল্যাটফর্মে ‘সাইবার বুলিং’ নামক অপরাধ হিসেবে গণ্য।
সাইবার বুলিং হলো ডিজিটাল মাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজিং অ্যাপ, গেমিং প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি) কারও প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে করা অপমান, হুমকি বা ভীতিকর আচরণ। এটি সাধারণ বুলিং-এর মতোই ক্ষতিকর, তবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হওয়ায় এর প্রভাব আরও ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
বর্তমান যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে ডিজিটাল বিশ্বে সাইবার বুলিং একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে এটি কেবল কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রাপ্তবয়স্করাও নিয়মিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মেসেজিং অ্যাপ এবং অনলাইন কমিউনিটিতে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এই হয়রানির প্রকাশ ঘটে বিভিন্নভাবে – কখনো পেশাগত জীবনে, কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আবার কখনো শুধু অনলাইন ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে। একজন চাকরিপ্রার্থী তার যোগ্যতা নিয়ে অপমানকর মন্তব্যের সম্মুখীন হতে পারেন, একজন নারী তার অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার হওয়ার শিকার হতে পারেন, অথবা কেউ শুধু ভিন্ন মত প্রকাশ করায় টার্গেট হতে পারেন।
সাইবার বুলিংয়ের সাধারণ ধরন:
- অপমান বা গালাগালি (যেমন: “তুমি খুব মোটা”)
- গুজব ছড়ানো (মিথ্যা কথা বলে কারও সম্মান নষ্ট করা)
- হুমকি দেওয়া (“তোমাকে গুম করব / মেরে ফেলব” – এমন বার্তা পাঠানো)
- ব্যক্তিগত তথ্য লিক করা (কারও ফোন নম্বর বা ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া)
- সোশ্যাল মিডিয়ায় বাদ দেওয়া (গ্রুপ থেকে বের করে দিয়ে একা করে দেওয়া)
- ফেক অ্যাকাউন্ট বানিয়ে হয়রানি (কারও নামে ভুয়া প্রোফাইল খুলে অপপ্রচার করা)
বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাইবার বুলিংয়ের অবস্থা
ফেসবুক: ফেসবুকে সাইবার বুলিং বেশ সাধারণ। এখানে বুলিংয়ের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- অপমানজনক মন্তব্য (যেমন: “তুমি খুবই কুৎসিত”)
- গুজব ছড়ানো (যেমন: কারও সম্পর্কে মিথ্যা কথা পোস্ট করা)
- হুমকি দেওয়া (যেমন: “তোমাকে স্কুলে মারব”)
উদাহরণ: একজন ছাত্রীকে তার ছবির নিচে ক্লাসমেটরা “মোটা” বলে মন্তব্য করছে বারবার, যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে।
ইনস্টাগ্রাম: ইনস্টাগ্রামে সাইবার বুলিং মূলত-
- বডি শেমিং (কারও শরীর নিয়ে বিদ্রূপ করা)
- হেট স্টোরি বা পোস্ট (কারও বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক কন্টেন্ট শেয়ার করা)
- ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে হয়রানি
উদাহরণ: একজন কিশোরীর ছবি এডিট করে মিম বানিয়ে শেয়ার করা হচ্ছে, যাতে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
টিকটক ও অন্যান্য শর্ট-ভিডিও প্ল্যাটফর্ম: এখানে বুলিং বলতে-
- ভিডিওর কমেন্টে অপমান
- ডুয়েট বা স্টিচ করে কাউকে হেয় করা
- প্রাইভেট ভিডিও লিক করে বিব্রত করা
উদাহরণ: কারও ডান্স ভিডিওর নিচে কমেন্টে লিখছে, “এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে?” / “এতো বেকার লোকেরই সময় থাকে এসব ভিডিও বানাতে”
হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও মেসেজিং অ্যাপ: এখানে বুলিংয়ের ধরন-
- গ্রুপ চ্যাটে কাউকে ট্রোল করা
- প্রাইভেট মেসেজে অশালীন ছবি বা বার্তা পাঠানো
- কারও নামে ফেক স্ক্রিনশট ভাইরাল করা
উদাহরণ: ক্লাসের গ্রুপে এক ছাত্রকে নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। “কারো নামে ফেক স্ক্রিনশট বানিয়ে গ্রুপে শেয়ার করা হলো, যেখানে তাকে গালি দেয়া হচ্ছে!”
অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্ম: গেমিং কমিউনিটিতে বুলিং-
- খেলার সময় গালাগালি দেওয়া
- টিমে অপমান করা
- কারও আইডি হ্যাক করে অপব্যবহার করা
উদাহরণ: একজন খেলোয়াড়কে তার দলের সদস্যরা “নুব” বলে গালি দিচ্ছে এবং খেলায় ব্যর্থতার জন্য দোষ দিচ্ছে।
সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে যা করণীয়:
- প্রতিক্রিয়া না দেওয়া: যারা বুলিং করে তাদের উদ্দেশ্য হলো আপনার প্রতিক্রিয়া পাওয়া। তাই তাদের বার্তা বা কমেন্টের জবাব দেবেন না।
- রেকর্ড সংরক্ষণ করুন: স্ক্রিনশট বা রেকর্ড রাখুন, যাতে পরে রিপোর্ট করতে পারেন।
- ব্লক ও রিপোর্ট করুন: সব সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক এবং রিপোর্ট অপশন আছে। এটি ব্যবহার করুন।
- বিশ্বস্ত কাউকে জানান: বাবা-মা, শিক্ষক বা বন্ধুকে বলুন। একা লড়াই করবেন না।
- সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করুন: বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন (সিসিআইডি) এ অভিযোগ করতে পারেন। ওয়েবসাইট: https://www.cid.gov.bd/hot-line-number-for-cyber-complain
- মানসিক সহায়তা নিন: সাইবার বুলিংয়ে আক্রান্তরা প্রায়ই বিষণ্ণতায় ভোগেন। কাউন্সেলিং নিন বা হেল্পলাইনে কল করুন।
সাইবার বুলিং থেকে বাঁচার উপায়
- সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাইভেসি সেটিংস চেক করুন (যেমন: শুধু বন্ধুরা আপনার পোস্ট দেখতে পারবে)
- অপরিচিতদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবেন না
- শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন এবং টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু রাখুন
- অনলাইনে খুব ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না (যেমন: ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা)
- ইতিবাচক কমিউনিটিতে যুক্ত হোন (যারা সমর্থন দেয়, শুধু সমালোচনা করে না)
সাইবার বুলিং কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটি মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে, এমনকি আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। তাই এই সমস্যা নিয়ে চুপ করে থাকবেন না। এটি কেবল ‘অনলাইনে কিছু শব্দ’ নয় – এটি ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা, পেশাগত সুনাম এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের প্রতিটি ডিজিটাল কর্ম কীভাবে অন্যের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়ে চিন্তা করা উচিত। সামান্য সচেতনতা এবং দায়িত্বশীল আচরণই আমাদের ডিজিটাল হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে। সচেতন হোন, সাহায্য নিন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।