ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে ‘কুকিজ’ এক্সেপ্ট করার পপ-আপ অপশন কখনো না কখনো নিশ্চয় পেয়েছেন। ডিভাইসের ‘ক্যাশ ক্লিন’ করার ব্যাপারটার সঙ্গেও হয়তো আপনি পরিচিত। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন— এই ‘ক্যাশ’ আর ‘কুকিজ’ আসলে কী? কী কাজ করে এগুলো? এবং এগুলো আপনার অনলাইন অভিজ্ঞতায় ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে?
ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় ব্রাউজার আমাদের কিছু তথ্য জমা রাখে। এতে করে পরবর্তীতে একই ওয়েবসাইটে গেলে দ্রুত প্রবেশ করা যায়। এই জমা রাখা তথ্যগুলোর মধ্যে প্রধান দুইটি হলো ক্যাশ এবং কুকিজ।
ক্যাশ (Cache): ব্রাউজার ওয়েবসাইটের ছবি, ভিডিও, ডিজাইন ফাইলগুলো আপনার ফোন বা কম্পিউটারে সাময়িকভাবে সেভ করে রাখে। যেমন, আপনি ফেসবুক খুললে তার লোগো বা আইকনগুলো বারবার ডাউনলোড না হয়ে ক্যাশ থেকে লোড হয়, তাই সাইট দ্রুত খোলে।
কুকিজ (Cookies): ছোট্ট টেক্সট ফাইল যেখানে আপনার লগইন তথ্য, পছন্দের সেটিংস বা আপনি কোন পেজে গিয়েছিলেন তা সেভ থাকে। যেমন, আপনি শপিং সাইটে লগইন করলে কুকিজ আপনাকে মনে রাখে, তাই বারবার পাসওয়ার্ড দিতে হয় না।
ক্যাশ আর কুকিজ কীভাবে কাজ করে?
ক্যাশ:
- আপনি যখন কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করেন, আপনার ব্রাউজার HTML, CSS, JavaScript এবং ইমেজ ডাউনলোড করে।
- পরবর্তীতে আবার সেই সাইট ভিজিট করলে ব্রাউজার ক্যাশ চেক করে।
- যদি ক্যাশের ডেটা এখনও ভ্যালিড থাকে, তাহলে সার্ভার থেকে নতুন করে ডাউনলোড না করে ক্যাশ থেকে লোড করে।
ক্যাশের প্রকারভেদ:
- ব্রাউজার ক্যাশ – আপনার ডিভাইসে ওয়েবসাইট রিসোর্স জমা রাখে।
- সিডিএন ক্যাশ – কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক সার্ভারে ফাইল জমা রাখে।
- ডিএনএস ক্যাশ – ডোমেইন নেম দ্রুত এক্সেসের জন্য সংরক্ষণ করে।
- সার্ভার ক্যাশ – ওয়েবসাইট ডাইনামিক কন্টেন্ট সংরক্ষণ করে।
কুকিজ:
- আপনি যখন কোনো সাইট ভিজিট করেন, সার্ভার একটি কুকিজ আপনার ব্রাউজারে পাঠায়।
- ব্রাউজার এই কুকিজ সংরক্ষণ করে।
- পরবর্তীতে সেই সাইটে গেলে ব্রাউজার কুকিজটি সার্ভারে ফেরত পাঠায়।
কুকিজের প্রকারভেদ:
- সেশন কুকিজ – অস্থায়ী, ব্রাউজার বন্ধ করলে মুছে যায়
- পারসিস্টেন্ট কুকিজ – নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে
- ফার্স্ট-পার্টি কুকিজ – আপনি যে সাইট ভিজিট করেন সেটি তৈরি করে
- থার্ড-পার্টি কুকিজ – বিজ্ঞাপন বা অ্যানালিটিক্স সার্ভিস তৈরি করে
ক্যাশ আর কুকিজ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- দ্রুত ব্রাউজিং: ক্যাশ না থাকলে প্রতিবার পুরো ওয়েবসাইট নতুন করে লোড করতে হতো, যা সময় ও ডেটা নষ্ট করত।
- সুবিধাজনক ব্যবহার: কুকিজের কারণে আপনাকে বারবার লগইন করতে হয় না, শপিং কার্টে জিনিস রাখলে তা সংরক্ষিত থাকে।
- ইন্টারনেট ডেটা বাঁচায়: ক্যাশ থাকায় একই ডেটা বারবার ডাউনলোড করতে হয় না।
নিরাপত্তা ঝুঁকি:
ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় ক্যাশ ও কুকিজ আমাদের ব্রাউজিংকে দ্রুত ও সহজ করে, কিন্তু এগুলোর কিছু নিরাপত্তা ঝুঁকিও আছে। যেমন-
ক্যাশ থেকে সমস্যা:
- প্রাইভেসি লিক: যদি কেউ আপনার ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করে, তাহলে ক্যাশ থেকে আপনার দেখা ওয়েবসাইটের তথ্য পেতে পারে।
- আউটডেটেড কন্টেন্ট: কখনো কখনো পুরানো ক্যাশ ডেটার কারণে ওয়েবসাইট সঠিকভাবে লোড হয় না বা নতুন আপডেট দেখা যায় না।
কুকিজ থেকে সমস্যা:
- ট্র্যাকিং: কিছু কুকি আপনার ব্রাউজিং এক্টিভিটি রেকর্ড করে, যা প্রাইভেসির জন্য ভালো নয়।
- হ্যাকিং ঝুঁকি: যদি কোনো হ্যাকার আপনার সেশন কুকি চুরি করে (যেমন—পাবলিক Wi-Fi ব্যবহার করার সময়), তাহলে তারা আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়তে পারে।
- জাঙ্ক কুকি: অনেক সাইট অপ্রয়োজনীয় কুকি জমা রাখে, যা ডিভাইস স্লো করে দিতে পারে।
ক্যাশ ও কুকিজ নিয়মিত ডিলিট করা কেন জরুরি?
- প্রাইভেসি সুরক্ষা: আপনার ব্রাউজিং হিস্ট্রি, লগইন ডিটেইলস অন্য কেউ যেন দেখতে না পায়। ট্র্যাকিং এড়ানো যায়।
- স্পিড বাড়ায়: অনেকদিনের জমে থাকা ক্যাশ ব্রাউজারের গতি কমিয়ে দেয়। পুরানো বা অপ্রয়োজনীয় ডেটা মুছে দিলে ব্রাউজার দ্রুত কাজ করে।
- সাইবার অ্যাটাক থেকে বাঁচায়: ম্যালিসিয়াস কুকিজ বা ট্র্যাকার মুছে ফেললে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি কমে। হ্যাকারদের আক্রমণের ঝুঁকি কমে।
- সঠিক ওয়েবসাইট দেখায়: পুরানো ক্যাশ মুছে দিলে ওয়েবসাইটের নতুন ভার্সন ঠিকভাবে লোড হয়।
ক্যাশ ও কুকিজ থেকে নিরাপদ থাকার সহজ উপায়:
- নিয়মিত ক্যাশ ও কুকিজ ডিলিট করুন। যেভাবে করবেন:
– ক্রোম/মাইক্রোসফট এজ: `Ctrl+Shift+Del` → “ক্যাশড ইমেজ ও ফাইল” + “কুকিজ” সিলেক্ট করুন।
– ফায়ারফক্স: `Ctrl+Shift+Del` → দুই অপশনই চেক করুন।
– সাফারি: `হিস্ট্রি → ক্লিয়ার হিস্ট্রি`।
– ব্রাউজার সেটিংস থেকে “অটো ক্লিয়ার” অন করে রাখুন (Privacy সেকশনে)। - ব্যাংকিং বা শপিংয়ের সময় প্রাইভেট মোড ব্যবহার করুন। প্রাইভেট মোডে কুকিজ ও ক্যাশ জমা হয় না, তাই নিরাপদ। যেভাবে প্রাইভেট মোড চালু করবেন:
– ক্রোম/মাইক্রোসফট এজ: `Ctrl+Shift+N` (ইনকোগনিটো)।
– ফায়ারফক্স: `Ctrl+Shift+P` (প্রাইভেট)।
– সাফারি: `ফাইল → নিউ প্রাইভেট উইন্ডো`।
- থার্ড-পার্টি কুকিজ ব্লক করুন। এতে করে এডভার্টাইজাররা আপনার ব্রাউজিং হিস্ট্রি ট্র্যাক করতে পারবে না। যেভাবে করবেন:
– ক্রোম: `সেটিংস → Privacy → থার্ড-পার্টি কুকিজ → ব্লক।
– ফায়ারফক্স: `অপশন → Privacy → Enhanced Tracking Protection`
– সাফারি: `প্রিফারেন্স → Privacy → ক্রস-সাইট ট্র্যাকিং ব্লক করুন।
– কিছু সাইট (যেমন YouTube, Facebook) ঠিক মতো কাজ নাও করতে পারে। - “ডু নট ট্র্যাক” (DNT) অন করুন যা ওয়েবসাইটগুলোকে আপনার অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাক না করার অনুরোধ জানাবে। যেভাবে অন করবেন:
– ক্রোম/মাইক্রোসফট এজ: `সেটিংস → Privacy → “Do Not Track” রিকোয়েস্ট পাঠান`।
– ফায়ারফক্স: `অপশন → Privacy → “Do Not Track” চালু করুন`।
- ব্রাউজারে পাসওয়ার্ড সেভ না করে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন। কারণ ব্রাউজারে সেভ করা পাসওয়ার্ড হ্যাকারদের টার্গেট হতে পারে। কয়েকটি নির্ভরযোগ্য পাসওয়ার্ড ম্যানেজার:
– Bitwarden বা KeePass ব্যবহার করুন (ফ্রি ও নিরাপদ)। - ব্রাউজার ও অ্যান্টিভাইরাস আপডেট রাখুন। এতে আপডেটেড সিকিউরিটি ফিচাররগুলোর সুবিধা পাবেন এবং হ্যাকারদের আক্রমণ ঠেকানো যাবে। যেভাবে করবেন:
– ব্রাউজারের “অটো-আপডেট” চালু রাখুন।
– “Windows Defender” বা “Malwarebytes” ব্যবহার করুন। - পাবলিক Wi-Fi ব্যবহার করে সেনসিটিভ কাজ করবেন না। পাবলিক Wi-Fi-তে হ্যাকাররা আপনার কুকিজ আকারে থাকা তথ্য চুরি করতে পারে। নিরাপদ উপায়:
– মোবাইল ডাটা ব্যবহার করুন।
– পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় অবশ্যই VPN (ProtonVPN) সচল করুন। - ব্যবহারের পর অ্যাকাউন্ট থেকে লগ আউট করুন যাতে কুকিজ চুরি হলেও হ্যাকাররা লগইন এক্সেস না পায়। কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি:
– শুধু ট্যাব বন্ধ করবেন না, “লগ আউট” বাটন ক্লিক করুন।
– একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে এমন ডিভাইসে লগ ইন তথ্য সেভ করবেন না। অর্থাৎ “Remember Me” এই অপশনে ক্লিক করবেন না।
- অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশন মুছে ফেলুন। কারণ কিছু এক্সটেনশন কুকিজ চুরি করে বা ম্যালওয়্যারের মতো ভাইরাস ইনস্টল করে। যেভাবে মুছে ফেলবেন:
– ক্রোম: `chrome://extensions` এ গিয়ে এক্সটেনশন চেক করুন।
– ফায়ারফক্স: `about:addons` এ গিয়ে সন্দেহজনক এক্সটেনশন ডিলিট করুন। - সাধারণ ব্রাউজিং ও সেনসিটিভ কাজের জন্য আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করুন। যেভাবে করবেন:
– সাধারণ ব্রাউজিং: Chrome/Firefox
– সিকিউর ব্রাউজিং: Brave Browser বা Firefox Focus (ব্যাংকিং, ই-মেইলের জন্য)। - নিরাপদ ব্রাউজিংয়ের অবশ্য করণীয়:
– মাসে একবার ক্যাশ-কুকিজ ক্লিয়ার করুন।
– প্রাইভেট মোডে সেনসিটিভ ব্রাউজিং করুন।
– থার্ড-পার্টি কুকিজ ব্লক করুন।
– “Do Not Track” অন করুন।
– পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন।
– ব্রাউজার ও অ্যান্টিভাইরাস আপ টু ডেট রাখুন।
– পাবলিক Wi-Fi ব্যবহারের সময় VPN সচল করুন।
– ব্যবহারের পর অ্যাকাউন্ট থেকে লগ আউট করুন।
– অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশন ডিলিট করুন।
– সাধারণ এবং সেনসিটিভ কাজের জন্য আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করুন।
এই সহজ নিয়মগুলো মেনে চললে ক্যাশ ও কুকিজের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকা যাবে কোনো টেকনিক্যাল জ্ঞান ছাড়াই!
ক্যাশ আর কুকিজ আমাদের ব্রাউজিংকে সহজ করে, কিন্তু এগুলোর অতিরিক্ত জমে থাকা প্রাইভেসি আর স্পিডের জন্য ক্ষতিকর। তাই মাসে একবার বা যখন ব্রাউজার ধীরগতির হয়ে যায়, তখন ক্যাশ-কুকিজ ক্লিয়ার করে নিন। আর বেশি সেনসিটিভ কাজ (যেমন—অনলাইন ব্যাংকিং) করার সময় প্রাইভেট মোড ব্যবহার করলে আরও নিরাপদ থাকবেন।